দুলি দুহি পিটা ধরণ না জাই | কুক্কুরীপাদের চর্যা ২
পয়েন্ট দেখুন(toc)
(ads1)
মূলপদ
রাগ গবড়া—কুক্কুরীপাদানাম্॥
দুলি দুহি পিটা ধরণ না জাই।
রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ ৷৷
আঙ্গণ ঘরপণ সুণ ভো বিআতী।
কানেট চৌরি নিল অধরাতী। ধ্রু॥
সুসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ।
কানেট চোরে নিল কা গই মাগঅ॥ ধ্রু॥
দিবসই বহুড়ী কাউই ডরে ভাঅ।
রাতি ভইলেঁ কামরু জাঅ॥ ধ্রু॥
অইসন চর্যা কুক্কুরীপাএঁ গাইউ।
কোড়ি মঝেঁ একু হিঅহি সমাইউ॥ ধ্রু॥
ভাবানুবাদ
দুলিকে দুহিয়া পীঠে ধরণ না যায়।
বৃক্ষের তেঁতুল ফল কুম্ভীরে খায়॥
অঙ্গন যে ঘরপর, শুন অবধূতি।
“কানেট’ যে দোষ চোরে নিল আধ রাতি॥
শ্বশুর নিদ্রিত হল, বধূ আছে জাগি।
“কানেট’ যে চোরে নিল, কোথা গিয়ে মাগি ৷৷
দিবসে বধূটি কাঁদে সদা ভয়ে ভীত।
রাত্রিতে চলিয়ে যায় কামে হতে প্রীত।
এইরূপ চর্যাপদ কুক্কুরীপাদ গায়।
কোটি মাঝে এক যোগী-হৃদয়ে সামায়।।
বাচ্যার্থ বা আক্ষরিক অর্থ
১-২ মাদি কাছিম দোহন করা হল, পাত্রে [দুধ] ধরে না (বা ধরা যায় না)। গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়।
৩-৪, আঙিনাতেই ঘর-সংসার (বা অন্য ব্যাখ্যায়, ঘরের কাছে আঙিনা)। ওগো বধূ, শোন। অর্ধরাত্রে চোর [এসে] কানেট (=কর্ণভূষণ) নিয়ে গেল।
৫-৬, শ্বশুর নিদ্রা গেল, বধূ [রইল] জেগে। চোরে কানেট নিলে কার কাছে গিয়ে সন্ধান করা যায় (বা চাওয়া যায়)?
৭-৮, দিনে বধূ কাকের ভয়ে ভীত হয়, রাত্রিতে কামসেবার্থে (বা কামরূপ) যায়।
৯-১০, এইরকম চর্যা কুক্কুরীপাদের দ্বারা গাওয়া হল, কোটির মধ্যে মাত্র একটি হৃদয়েই তা প্রবেশ করল।
(ads2)
----------------
গূঢ়ার্থ ব্যাখ্যা॥ আলোচনা
টীকাকার মুনিদত্ত এই চর্যার ব্যাখ্যারম্ভে বলেছেন “তমেব মহাসুখ-রাজানম্...কুক্কুরীপাদাঃ সন্ধ্যাভাষয়া প্রকটয়িতুমাহুঃ” অর্থাৎ মহাসুখলাভের তত্ত্ব এখানে সন্ধ্যা ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। সন্ধ্যা ভাষা বলেই এই চর্যার প্রায় প্রত্যেক কথারই বাচ্যার্থের ভিতরে আর একটি করে আভিপ্রায়িক অর্থ নিহিত আছে।
সেই অনুসারে ‘দুলি’র অর্থ সর্বপ্রকার দ্বৈতত্ত্ব বা তার প্রতীক দেহের দুই পাশের দুই নাড়ী। দোহনজাত বস্তু ‘সংবৃত্তি বোধিচিত্ত’, পীঠ নাভিদেশে অবস্থিত মণিপুর চক্র। বৃক্ষ দেহবৃক্ষ, তেন্তলি বক্রগামী বোধিচিত্ত, কুম্ভীর যৌগিক কুম্ভক, কুম্ভীর তেঁতুল ভক্ষণের অর্থ কুম্ভক যোগে বোধিচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করা। বিআতী ও বহুড়ী হল অবধূতিকা। সহজানন্দের আশ্রয় মহাসুখচক্রই হল ঘর এবং অঙ্গন হল বিরমানন্দস্থান। কানেট হল প্রকৃতিদোষ, চোর সহজানন্দ। অর্ধরাত্রি হল সহজানন্দে বিলীন হবার পূর্বক্ষণ। শ্বশুর শ্বাসবায়ু, দিবস চিত্তের প্রবৃত্তিময় অবস্থা, রাত্রি নিবৃত্তির অবস্থা এবং কামরূপ মহাসুখচক্র।
এই সব সন্ধ্যাশব্দের মাধ্যমে আসলে সহজানন্দ উপভোগের উপায়ই বর্ণনা করা হয়েছে, এই উপায় অদীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছে গোপন রাখার জন্যই প্রহেলিকার অবতারণা। এই প্রহেলিকার আসল অর্থ হচ্ছে, বামগা ও দক্ষিণগা দুই নাড়ীর দ্বৈতত্ব ও স্বাভাবিক গতি নষ্ট করে তাদের মধ্যমার্গে একত্র করলে বোধিচিত্তকে আর নাভিস্থিত মণিপুরচক্রে ধরে রাখা যায় না, তখন তা ঊর্ধ্বগামী হয়। কুম্ভকযোগের দ্বারাই দেহতরুর ফলস্বরূপ এই বোধিচিত্তকে নিঃস্বভাব বা বিশুদ্ধ করা যায়। বোধিচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করে মধ্যমার্গে ঊর্ধ্বগামী করলে সাধকের যে আনন্দ হয় সেই আনন্দানুভূতির তৃতীয় ও চতুর্থস্তর যথাক্রমে বিরমানন্দ ও সহজানন্দ আঙিনা ও ঘরের মতই পরস্পরের সমীপবর্তী, সহজানন্দে বিলীন হবার পূর্বক্ষণে সাধক যদি কুম্ভকযোগে চিত্তের প্রকৃতিদোষ হরণ করেন তবে তিনি এই আনন্দ লাভ করেন। এই সময়ে শ্বাসবায়ু যোগনিদ্রায় নিশ্চল ও নিযুপ্ত হয়ে পড়ে এবং ভববিকল্পাদিমুক্ত প্রকৃতিপরিশুদ্ধ অবধূতিকা নাড়ীর জাগরণ ঘটে, এবং প্রকৃতিদোষ লুপ্ত হওয়ায় গ্রাহ্যগ্রাহক ভাবও অন্তর্হিত হয়। সাধকের পক্ষে এই প্রকৃতিপ্রভাস্বর সর্বশূন্য অবস্থাই পরম কাম্য, এ অবস্থায় উপনীত হলে আর কিছুই প্রার্থনীয় থাকে না। সাংবৃতিক বা প্রবৃত্তিময় অবস্থায় চিত্ত জরামরণপূর্ণ এই জগতের দৃশ্যে সন্ত্রস্ত হয়, কিন্তু পারমার্থিক অবস্থায় পরিশুদ্ধ চিত্ত নির্বিকল্পাকারে মহাসুখচক্রে গমন করে।
কুক্কুরীপা-এর গাওয়া এই গান এমনি (প্রহেলিকাময়) যে কোটির মধ্যে হয়তো মাত্র একজনের হৃদয়েই এর তত্ত্ব প্রবেশ করবে।
আমাদের টেলিগ্রাম ও ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হোন
👇👇👇👇
সাহায্য - মণীন্দ্রমোহন বসু ও নির্মল দাশ