Ads Area

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য রাধা চরিত্র


বড়ুচণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যটির মধ্যমণি হলো রাধা চরিত্র। কবি শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য কীর্তনের উদ্দেশ্যে হয়তো কাব্য রচনা করেছিলেন। কারণ কাব্যের নাম হিসেবে আমরা 'শ্রীকৃষ্ণসন্দর্বঃ' (শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ) লেখা চিরকুটটির কথা স্মরণ করতে পারি। তথাপি এ কাব্যের সকল গৌরব আত্মসাৎ করেছে রাধা চরিত্রটি। মনস্তত্ত্ব সম্মত উপায়ে রাধা চরিত্রটি বিকশিত হয়ে উঠেছে কবির সুনিপুণ লেখনী-স্পর্শে। পূর্ণাঙ্গ নারী চরিত্ররূপে রাধাকে চিত্রিত করার মধ্যে কবি তাঁর অতুলনীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এগারো বছরের বালিকা ধীরে ধীরে দেহচেতনা ও প্রেমচেতনায় পরিপূর্ণ মানবীরূপে উপস্থিত হয়েছে এ কাব্যে—"বংশীখণ্ড" সেই পরিণত নারীর পরিণত প্রণয়ের চিহ্ন বহন করছে। কৃষ্ণ বীতরাগিনী রাধাকে কৃষ্ণ-অনুরাগিনীতে রূপান্তরিত করার মনস্তত্ত্বসম্মত পন্থাটি বড়ু চণ্ডীদাসের চরিত্র চিত্রণে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়বাহী।

'তাম্বুলখণ্ডে' কৃষ্ণ-প্রেরিত কর্পূর তাম্বুল রাধা পদদলিত করেন। কারণ তাঁর কাছে সমাজজীবন ও পরিবারজীবনই সবচেয়ে বড়। তাঁর মনে আছে আজন্ম লালিত সতীত্বের সংস্কার, স্বামী-প্রীতি অথবা স্বামীভীতি। আর আছে কুল, শীল, মান, মর্যাদা ও আপনরূপ-যৌবন সম্পর্কে সচেতনতা ও করলো অহংবোধ। তাই বড়ায়িকে রাধা বলেছেন,

"ঘরের সামী মোর সর্বাঙ্গে সুন্দর আছে সুলক্ষণ দেহা। নান্দের ঘরের গরু রাখোয়াল তা সমে কি মোর নেহা।।"
[২২ সংখ্যক]

বড়ায়ি কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার প্রণয় সম্পর্কের সুফল হিসেবে বিষ্ণুপুরে স্থিতির কথা বললে রাধা স্পষ্টভাবে বড়ায়িকে জানান—

“ধিক জাউ নারীর জীবন দহেঁ পসু তার পতী। 
পর পুরুষের নেহাএঁ যাহার বিষ্ণুপুরে স্থিতী।।”
[২২ সংখ্যক]

সুতরাং রাধার মনে পাপ-পুণ্য, নৈতিকতা ও অনৈতিকতার প্রশ্নটি বেশ প্রবল। তথাপি এই নারীকে পাশবপ্রবৃত্তির কামনালোলুপ স্বেচ্ছাচারী কৃষ্ণের কাছে দেহসমর্পণ করতে হয়। 'দানখণ্ডে' বড়ায়ির সঙ্গে পরামর্শ করে কৃষ্ণ দানী সেজে অপেক্ষা করেন এবং রাধার কাছে বারো বছরের দান চান। রাধার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণও করেন তিনি যা এযুগের বিচারে অশ্লীল বলে মনে হতেই পারে। লজ্জিত রাধা আত্মরক্ষার তাগিদে কাহাঞিকে নানা ভাবে বোঝাতে সচেষ্ট হন। নিজের স্বামী, শ্বশুরঘর, এমনকি কংসের কথাও বলেন। সেই সঙ্গে বারবার কৃষ্ণকে তাদের সম্পর্কর কথা স্মরণ করান—“তোহ্মার মাউলানী আহ্মো শুন দেবরাজ।।” [পদ সংখ্যা ২১২]

কিন্তু এত করেও নিজের সতীত্ব রক্ষা করতে পারেন না রাধা। প্রাস্তরে একাকিনী রাধাকে বলপূর্বক সম্ভোগ করেন কৃষ্ণ। লজ্জায়, অপমানে, আত্মগ্লানিতে দগ্ধ রাধার অসহায় অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন কবি ১৪৫ নং পদে।

কিন্তু “নৌকাখণ্ডে” এই দেহচেতনার পথ ধরেই রাধার মনে প্রেমচেতনা জাগ্রত হয়েছে। 'নৌকাখণ্ডে'ও বলপূর্বক মিলনের পর রাধার মনে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। বড়ায়ির কাছেও সত্য গোপন করেছেন তিনি। কৃষ্ণের প্রশংসা করে বলেছেন,

“এবার কাহাঞি বড় কৈল উপকার।
 জরমে সুঝিতে নারা এ গুণ তাহার।” (১৭৬ নং) 

জাগ্রত যৌবনচেতনায় রাধার মনে কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ সঞ্চারিত হয়েছে। তাই "ভার’ ও ‘ছত্র’ খণ্ডে কানুর সঙ্গে রাধার ব্যবহারে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পূর্বের সেই উষ্মা, ক্ষোভ ও বীতস্পৃহা রাধার মধ্যে লক্ষ করা যায় না। বেশ সরসতাও লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে রাধার কথোপকথনে। 'বৃন্দাবন খণ্ডে’ রাধার নব-অনুরক্ত মনে অভিমান জাগ্রত হয়েছে, যার মূলে আছে আধিকারবোধ। কৃষ্ণ বহুমূর্তি হয়ে গোপীদের সঙ্গে বিলাসরত হলে রাধা অভিমানিনী হন। তখন কানাই জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দে'র কৃষ্ণের অনুরূপ ভঙ্গিতে রাধার মানভঞ্জনে সচেষ্ট হন—

"মদন গরল খণ্ডণ রাধা মাথার মণ্ডণ মোরে।
চরণপল্লব আরোপ রাধা মোর মাথার উপরে।।”
(২৩২ নং)

এখানে অনিবার্যভাবে আমাদের মনে পড়বে 'গীতগোবিন্দে' কৃষ্ণ উচ্চারিত সেই পক্তিগুলি—
" স্মরগরল খণ্ডনম
মম শিরসি মণ্ডনম্ 
দেহি পদপল্লবমুদারম্।।"

এখানে শুধু রাধার নয়, রাধার প্রতি শ্যামের অনুরাগটিও চকিতে উদ্ভাসিত। প্রেয়সী রাধা নিজের মনোভাব প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেন 'বৃন্দাবন' খণ্ডে পরবর্তী 'যমুনানতর্গত কালীয়দমনখণ্ডে।' কৃষ্ণ কালীয়নাগ দমনে প্রবৃত্ত হয়ে কালীদহে ঝাঁপ দিয়েছেন শুনে ক্রন্দনাকুল রাধা বলেন—

“আজি জখনে মো বাঢ়ায়িলোঁ পাএ
পাছেঁ ডাক দিল কালিনী মাএ।।
(২৪৬)


এখানে রাধার হৃদয়-আকুলতা চমৎকার প্রকাশিত হয়েছে, সেই সঙ্গে শোনা গেছে স্পষ্ট স্বীকারোক্তি--কৃষ্ণই তাঁর 'পরাণপতী'। রাধা চরিত্রকে এইভাবে ধীরে ধীরে বিকশিত করে তুলেছেন কবি। এ রাধার সঙ্গে বিদ্যাপতির রাধার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গেলেও চণ্ডীদাসের রাধার সঙ্গে একেবারেই মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আসলে পদাবলীর চণ্ডীদাসে রাধাকে প্রথমাবধি সর্বসমমর্পিত কৃষ্ণে নিবেদিত বিরহভারাতুরা সর্বংসহা চরিত্ররূপে চিত্রিত করেছেন। 'অল্পে অল্পে মুকুলিত হওয়ার সুযোগ সেখানে একেবারেই নেই। অপরদিকে, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কবি বাস্তব অভিজ্ঞতার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে রাধা চরিত্রকে রূপায়িত করেছেন। তাই সেখানে রাধার অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাঁর সামাজিক সত্তা ও ব্যক্তিসত্তার দ্বন্দ্ব এমন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। 

মধ্যযুগীয় সমাজে সমাজ ও পরিবারের পরম নিরাপদ গণ্ডী ভেঙে কোন নারীর পক্ষে পর-পুরুষের প্রেমে সাড়া দেওয়া সম্ভব ছিল না। তেমনি সম্ভব ছিল না পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া। কিন্তু বড়ুর রাধা সেই অসাধ্য সাধন করেছেন। কৃষ্ণের প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানে তাঁর সেই ব্যক্তিত্বের চিত্রণ আমরা 'তাম্বুলখণ্ডে" লক্ষ করেছি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্বীয় অস্তরে প্রেমের জাগরণে সমাজের ভ্রূভঙ্গিকে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন তিনি।

তবু যে কোন কুলবর্তী নারীরই প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা থাকে। তাই স্বীয় প্রেমকে যতবার প্রকাশ করেছেন রাধা, ততবারই তাকে গোপন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। 'বস্ত্রহরণখণ্ডে' কৃষ্ণ রাধার বস্ত্রহরণ করেন। শুধু রাধার নয়, সব গোপিনীরই হার ও বস্ত্র হরণ করেন তিনি। তারা বারবার সেগুলি ফেরত চাইলে কানাই জানান যে, রাধা যদি বিবস্ত্রা অবস্থায় ডাঙায় উঠে বস্ত্র প্রার্থনা করেন তবেই কৃষ্ণ সদয় হবেন। রাধা নিরুপায় হয়ে কৃষ্ণের কথা মতো কাজ করলেও কানু রাধাকে হার ফিরিয়ে দেন না, শুধু বস্ত্রটুকু দেন। ফলে অন্য গোপী সম্মুখে বিব্রত রাধা 'হারখণ্ডে' যশোদার কাছে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে হার চুরির অভিযোগ আনেন। ফলে কৃষ্ণ ক্ষুব্ধ, অপমানিত হন, এবং বড়ায়ির সঙ্গে পরামর্শ করে রাধাকে পুষ্পবাণে আহত করেন। পুষ্পবাণে আহত মৃতপ্রায় রাধাকে দেখে কৃষ্ণ বিলাপ করলেও উভয়ের সম্পর্ক আর পূর্বাবস্থায় থাকে না। বিশেষত, কৃষ্ণের মানসিক পরিবর্তন অধিক স্পষ্টরূপে ধরা পড়ে।

রাধা প্রেম-বিমুখ নন, প্রেম আকুল এক নারী। তার অন্তরর অবিরাম বেজে চলেছে প্রেমের বাঁশি। নিয়ত দগ্ধ হচ্ছে পরাণ। বাস্তব থেকে দৃষ্টান্ত চয়ন করে কবি বড়ুচণ্ডীদাস বংশী-ব্যাকুলা রাধা'র অন্তরবেদনা প্রকাশ করেছেন,

“বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জানী। 
মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুমভারের পণী।।”


"বংশীখণ্ডে" রাধা চরিত্র এইরূপে বিকশিত হয়েছেঃ

১) এই খণ্ডে রাধা বিবর্তিত ও পরিবর্তিত চরিত্র রূপে সমুস্থিত।
২) রাধার ব্যাক্তিসত্তার পাশাপাশি সামাজিক সত্তার পরিচয়ও সুপরিস্ফুট।
৩) বিরহের মধ্যে দিয়েই প্রেমের প্রকৃত স্বরূপ রাধার কাছে উদঘাটিত হয়েছে এবং চরিত্রটি পূর্ণতা পেয়েছে।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area