Ads Area

রঘুপতি চরিত্র বিসর্জন নাটক


‘বিসর্জন’ নাটকে রঘুপতি ভিলেন নয়। প্রথার প্রতি তাঁর অটুট বিশ্বাস। ধর্ম বিষয়ে রাজশক্তির হস্তক্ষেপকে সে অনধিকার চর্চা বলে মনে করে গোবিন্দমাণিক্যকে অপসারণ করে সে ধর্মকে দায়মুক্ত করতে চায়। গোবিন্দমাণিক্য মন্দিরে সৈন্য পাহারা বসালে ক্রোধান্বিত রঘুপতি রাজাকে বলেছেন –


অবিশ্বাসী সত্যই কি হয়েছে ধারণা,
কলিযুগে ব্রহ্মতেজ বেদ্ধে-- তাই এত দুঃসাহস
যায় নাই -- যে দীপ্ত অনল
জ্বলিছে অন্তরে, সে তোমার সিংহাসনে
নিশ্চয় লাগিবে।


এর পর থেকে রঘুপতি রাজা হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। নক্ষত্র রায়কে দিয়ে হত্যার চেষ্টা ফলপ্রসূ না হওয়ায় জয়সিংহকে সে এ হত্যায় প্ররোচিত করেছে। রঘুপতি দেবীর চরণ স্পর্শ করিয়ে জয়সিংহকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে যে 'শ্রাবণের শেষ রাত্রে এনে দিবে রাজরক্ত দেবীর চরণে।” অন্ধ ধর্মবোধের সঙ্গে ব্যক্তিগত ক্ষমতা লোভের আক্রোশ ও দম্ভ মিলেমিশে সে এক বিরাট অশুভ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। গুণবতীকেও তিনি রাজার বিরুদ্ধে তাঁর পাশে রেখেছেন। শিশু ধ্রুবকে মায়ের কাছে বলি দেবার উদ্যোগ করলে রঘুপতি বন্দী হন ও নির্বাসন দণ্ড লাভ করেন, কিন্তু রাজরক্তের আশায় তিনি কয়েকদিনের জন্য সময় প্রার্থনা করেন। জয়সিংহের আত্মবিসর্জনে রঘুপতির বিরুদ্ধতা ধুলোয় মিশে গেছে। আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি আনুগত্য, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা, আত্মাভিমান, ক্ষমতার এ সব কিছুর আড়ালে জয়সিংহের প্রতি ছিল রঘুপতির অকৃত্রিম দুর্বলতা।

রাজার সঙ্গে রঘুপতির সংস্কারের যুদ্ধ, ব্যক্তিত্বের যুদ্ধ, আত্মাভিমানের যুদ্ধ। এতে তার সত্য মিথ্যা নেই। পাপ-পুণ্য জান নেই, বিবেকের দংশন নেই। সে নক্ষত্ররায়কে বিদ্রোহী হতে প্ররোচিত করেছে। প্রতিমার মুখ ফিরিয়ে রেখে সরল বিশ্বাসপরায়ণ প্রজাদেরকে উত্তেজিত করেছে। প্রতিমার আড়ালে লুকিয়ে 'রাজরক্ত চাই' বলে চিৎকার করে দুর্বলচিপ্ত জয়সিংহকে রাজহত্যায় নিয়োগ করেছে এবং শেষে নির্বাসন দণ্ড পেয়ে চরম প্রতিশোধের আশায় কয়েকদিনের জন্য সময় ভিক্ষা করেছে। কিন্তু যে স্নেহ, প্রেম তার অন্তরের এককোণে অবরুদ্ধ আচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে ছিল, তা প্রচণ্ড বেগে আত্মপ্রকাশ করে সমস্ত সংস্কার, আত্মাভিমান, বুদ্ধির দপ্ত, কর্মপ্রচেষ্টাকে চূর্ণ করে দিল, জয়সিংহের মৃত্যু সেই অবরুদ্ধ স্রোতধারাকে কুলপ্লাবিনী করে রঘুপতিকে ভাসিয়ে দিল। ধর্মের সংস্কার ও আচার অনুষ্ঠানের প্রতি অন্ধনিষ্ঠা মানুষকে অনেক সময় হৃদয়হীন করে তোলে। নিদারুণ বেদনার মধ্য দিয়ে সে স্নেহ প্রেমের প্রকৃত মর্যাদা বুঝল, তার নরজন্ম হল। অহংকার অভিমান দেবতা ব্রাহ্মণ সব গেল, তবু জয়সিংহকে ফিরে পাওয়া গেল না। মৃত জয়সিংহের আত্মিক শক্তিতে তার পুনর্জন্ম হল। শিষ্য জয়সিংহ মরে শুরু রঘুপতির অন্তরাত্মাকে বাঁচাল। রঘুপতির তেজ, দম্ভ, অহংকার এক নিমেষে ধুলিসাৎ হয়ে গেল।

এই আমূল পরিবর্তন রঘুপতির জীবনের ট্র্যাজেডিকে হালকা করে দিয়েছে। জয়সিংহের মৃত্যু তাকে কুসংস্কারমুক্ত করেছে। জড় পাষাণের মধ্যে যে সত্যকার দেবী নেই সে সত্য জেনে রঘুপতি দেবীকে জলে নিক্ষেপ করেছে। জয়সিংহের মৃত্যুতে সে মোহমুক্ত। প্রেমের হাতে তার চরম পরাজয় এই ভাবটির মধ্যে শেষে রঘুপতি চরিত্রের মুক্তি। সংস্কার ধর্মের উপর প্রেম ধর্মের জয় ঘোষণা করা এই নাটকের মুখ্য উদ্দেশ্য।  রঘুপতি ও গুণবর্তীকে কেন্দ্র করে এ উদ্দেশ্য অনেকটাই সাধিত হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Ads Area